দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় হরহামেশায় থাকে মিষ্টি খাবার, আর মিষ্টি খাবার মানেই চিনি। এই চিনিকেই মূলত বলা হচ্ছে সাদা বিষ। এদিকে আরও দুটি খাবার ভাত ও রুটি তো একেবারে অপরিহার্য। এই দুটিও সাদা বিষ। কিন্তু এই তিন সাদা বিষ মুক্ত থাকতে এর বিকল্প খুঁজে বের করতে হবে।
হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ফ্যাটি লিভার ডিজিজ- এই রোগগুলোকে সাধারণভাবে বলা হয় লাইফস্টাইল ডিজিজ। বর্তমানে দেশে ৭৩ ভাগ মৃত্যুর কারণ এই অসংক্রামক রোগ। গত তিন দশকে এসব রোগ হুহু করে বাড়ার অন্যতম কারণ হলো রিফাইনড ফুড। চিনি, সাদা চাল ও ময়দা- ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে এই তিনটি রিফাইনড ফুডকে বলা হচ্ছে হোয়াইট পয়জন তথা সাদা বিষ।
চিনি কেন বিষ?
চিনি উৎপন্ন হয় আখ বা ইক্ষু গাছ থেকে। আখের রস নিঃসন্দেহে পুষ্টিকর। কিন্তু যখন তা ফুড ইন্ডাস্ট্রিতে রিফাইনড হয়, তখন ভালো উপাদানের অনেকটাই হারায়, যার মধ্যে আছে ভিটামিন, মিনারেল ও এন্টিঅক্সিডেন্ট। থাকে শুধু কার্বোহাইড্রেট, গ্লুকোজ আর ফ্রুকটোজ।
আখ যখন চিবিয়ে বা রস করে খাওয়া হয় তখন এতে থাকা ফাইবার বা আঁশ চিনির গ্লুকোজে পরিণত হয়ে রক্তে মেশার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত ও দীর্ঘায়িত করে। কিন্তু যখন সরাসরি চিনি খাওয়া হয় তখন প্রক্রিয়াটা দ্রুততর হয়ে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ চটজলদি বাড়িয়ে দেয়। এজন্যে এটা ক্ষতিকর বিষের মতোই।
চিনির কিছু ক্ষতিকর দিক
১। বাড়তি ওজন ও মেদস্থূলতার কারক
শরীরে যখন অতিরিক্ত গ্লুকোজ প্রবেশ করে, লিভার একে প্রথমে গ্লাইকোজেন এবং পরবর্তীতে ফ্যাট হিসেবে জমা করতে থাকে। ফলে ওজন বৃদ্ধি পায়। একটা পর্যায়ে লিভারে জমা হওয়া এই অতিরিক্ত ফ্যাট ফ্যাটি লিভার ডিজিজের সূত্রপাত ঘটায়।
২। টাইপ টু ডায়াবেটিস
আর একবার ফ্যাটি লিভার ডিজিজ হয়ে গেলে তা শরীরে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স এবং টাইপ টু ডায়াবেটিস তৈরি করে। অর্থাৎ আলটিমেট টাইপ টু ডায়াবেটিসের মূল কারণ চিনি!
৩। বার্ধক্যকে তরান্বিত করে
চিনি সেলুলার এইজকে বাড়িয়ে দেয়। ফলে নিয়মিত বেশি বেশি চিনি খেলে অল্প বয়সেই আপনাকে বুড়োটে দেখাবে।
৪। ইমিউন সিস্টেমকে ক্ষতিগ্রস্ত করে
আমাদের ইমিউন সিস্টেম রোগজীবাণু প্রতিহত করে আমাদেরকে সুস্থ রাখে। চিনি এই ইমিউন সিস্টেমকে ক্ষতিগ্রস্ত করে রোগগ্রস্ত হওয়ার দ্বার উন্মোচিত করে।
৫। চিনি ক্যান্সার কোষের একমাত্র খাবার। কারো শরীরে যদি ক্যান্সার কোষ তৈরি হয় তবে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে যদি তিনি চিনি খান।
চিনি মাদকের মতোই আসক্তিকর!
আপনি যদি প্রতিদিন একটা নির্দিষ্টি সময়ে কোক, চিনিযুক্ত চা বা চিনিসমৃদ্ধ অন্য খাবার খান তাহলে দেখবেন দিনের ঠিক ওই সময়টাতে শরীরে অস্থিরভাব হচ্ছে; মনে হবে কী যেন খাওয়া হয় নি! যখনই আবার জিনিসটি খাচ্ছেন, ছটফটানি কমে যাচ্ছে। এর কারণ হলো মাদকের মতো চিনিও আসক্তিকর।
অসংখ্য গবেষণায় চিনির আসক্তিকর দিকটি উন্মোচিত হয়েছে; আসক্তির দিক থেকে চিনিকে তুলনা করা হয়েছে কোকেনের সাথে। তাই চিনি বাদ। এর পরিবর্তে খেতে পারেন গুড়, মধু, খেজুর।
বাকি দুই সাদা বিষ- সাদা চাল এবং সাদা ময়দা
চালের খোসার নিচে থাকা লাল আবরণ পুষ্টিগুণে ভরপুর। আর চালের ওপরের ভাগে থাকে উপকারী শর্করা বা গুড কার্ব। চালকে সাদা আর চিকন করতে লাল আবরণসহ চালের ওপরের অংশ ছেঁটে ফেলা হয়। রয়ে যায় যে অংশ তা মূলত ব্যাড কার্ব বা ক্ষতিকর শর্করা।
একই ব্যাপার ঘটে সাদা আটা ও ময়দার ক্ষেত্রেও। গমের তিনটি স্তর। বাইরের স্তর হচ্ছে ব্রান, যাতে থাকে প্রোটিন, ফাইবার, ভিটামিন বি, আয়রন, কপার, জিংক, ম্যাগনেশিয়াম, ফাইটোক্যামিকেল ও এন্টিঅক্সিডেন্ট। রিফাইনিংয়ের মাধ্যমে এই ব্রানটাকে ফেলে দেয়া হয়।
আপনি যখন আস্ত গমের লাল আটার রুটি বা লাল চালের ভাত খান তখন শরীর সব পুষ্টি পায়। কিন্তু রিফাইনিং ইন্ডাস্ট্রিতে গিয়ে লাল চাল যখন সাদা চাল আর গম যখন সাদা আটা বা ময়দায় পরিণত হয় তখন হারায় ভিটামিন, মিনারেল, প্রোটিন, ফাইবার। রয়ে যাওয়া ব্যাড কার্ব ওজন বৃদ্ধিসহ অনেক রোগ, যেমন- ফ্যাটি লিভার ডিজিজ, স্থূলতা, ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স, টাইপ টু ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপের কারণ হয়। অর্থাৎ সাদা বিষ নামটা একেবারে সার্থক!
খেয়ে অভ্যস্ত; প্রতিকার কী?
প্রতিকার হলো খাবারগুলো পুরোপুরি বর্জন! একটু নির্দয় শোনালেও হোয়াইট পয়জন থেকে বাঁচতে এর বিকল্প নেই। তবে কিছু বিকল্প খাবার খুঁজে নিলে হোয়াইট পয়জন বর্জন করাটা আপনার জন্যে সহজ হবে।
মিষ্টিস্বাদের জন্যে মন ছটফট করছে? মিষ্টি ফল খান। একদিকে চিনি বর্জন হবে, অন্যদিকে মিলবে ফলের পুষ্টি।
লাল চাল ও লাল আটা একটু খুঁজলে আপনার আশেপাশেই পেয়ে যাবেন। সাদা চাল ও সাদা আটা বা ময়দার বিকল্প হিসেবে এগুলোই বেঁছে নিন। দাম হয়তো একটু বেশি; তবে এই বাড়তি খরচ থেকে আখেরে উপকার হবে আপনারই!